https://fictionfactory.org/posts/13551

সিগারেট ও বিড়ির গল্প: ধোঁয়ার ভেতরে জীবন

রাজশাহীর একটা ছোট্ট গ্রামে জন্ম নেয়া সোহাগের জীবনের শুরুটা ছিল সাধারণই। বাবা ছিলেন একজন কৃষক, মা গৃহিণী। স্কুলে ভালোই পড়াশোনা করত সে। কিন্তু কৈশোরের মাঝামাঝি বয়সেই জীবনে ঢুকে যায় সিগারেট ও বিড়ির ধোঁয়া

প্রথম দিনটা ছিল মেলায়। বড় ভাইয়ের সঙ্গে গিয়েছিল। সেখানে একদল ছেলেকে কোণের ভেতরে দাঁড়িয়ে বিড়ি খেতে দেখে কৌতূহল জাগে। ভাইয়ের এক বন্ধু মজা করে বলল,
— "চেষ্টা করবি? বড় হয়ে গেছিস তো!"

সোহাগ তখন কেবল ১৩ বছরের। কৌতূহল মেটাতে টান দিয়েছিল প্রথম বিড়িটা। গলা জ্বালা করে উঠল, কাশতে কাশতে চোখে পানি চলে এল। সবাই হেসে উঠল। কিন্তু মনে মনে এক অদ্ভুত আনন্দও পেল— যেন সে সত্যিই বড় হয়ে গেছে।

ধোঁয়ার প্রথম আসক্তি

ধীরে ধীরে তার বন্ধুদের সাথে লুকিয়ে বিড়ি খাওয়া শুরু হলো। পকেট খরচের টাকা থেকে প্রতিদিন একটা-দুটো বিড়ি কিনত। মায়ের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে গায়ের জামা বাইরে শুকাত, যেন ধোঁয়ার গন্ধ না টের পাওয়া যায়।
বিড়ির তিক্ত ধোঁয়া কিছুদিন পর তাকে আর কষ্ট দিত না। বরং মনে হতো শান্তি আসে, ক্লান্তি কমে যায়।

স্কুলের শেষ দিকে এসে বিড়ি থেকে সিগারেটে উঠল। একবার টানলে মনে হতো যেন দুনিয়া হালকা হয়ে গেল। বন্ধুদের আড্ডা, চায়ের দোকানের কোণে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধোঁয়ার ভেতরে সময় কাটানো তার নেশায় পরিণত হলো।

পরিবারের ভাঙন

বাবা বুঝতে পারলেন ছেলের অভ্যাস। রাগারাগি করলেন, মারধরও হলো। কিন্তু তাতে কিছুই হলো না। বরং সোহাগ আরও গোপনে সিগারেট খাওয়া শুরু করল।
মা কেঁদে কেঁদে বলতেন,
— "বাবা, এ অভ্যাস ছেড়ে দে, না হলে একদিন শরীর ভেঙে পড়বে।"

কিন্তু কিশোর বয়সের জেদে তখন এসব কথা তার কানে যেত না।

শহরে যাওয়া

এইচএসসি পাস করার পর সোহাগ ঢাকায় পড়তে এলো। এখানে স্বাধীনতা আরও বেশি। বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ গাঁজাও খায়। তবে সোহাগ সেই পথে যায়নি, কিন্তু সিগারেটের ওপর নির্ভরশীলতা আরও বেড়ে গেল।
পরীক্ষার চাপ, টিউশনের দৌড়ঝাঁপ, একাকীত্ব— সবকিছুর অবসান ঘটাত এক টান। দিনে দিনে তার খরচের বড় অংশ সিগারেটে চলে যেতে লাগল।

প্রথম ভালোবাসা

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় পরিচয় হলো মিতার সঙ্গে। মেয়েটি মিষ্টি হাসি আর গভীর চোখে তাকাত। সোহাগের ধূমপানের অভ্যাসটা ওর একদম পছন্দ ছিল না।
— "তুমি ধূমপান করলে আমার পাশে দাঁড়ানো কষ্ট হয়ে যায়। গন্ধে সহ্য করতে পারি না।"

প্রথম প্রেমের টানে সোহাগ প্রতিজ্ঞা করল সে ছাড়বে। সত্যিই কয়েক মাস চেষ্টা করল। সিগারেট ফেলে দিল, নতুন জামা পরল, মুখে লজেন্স রাখল।
মিতা খুশি হলো। বলল,
— "দেখেছো? তুমি পারো। শুধু ইচ্ছা দরকার।"

কিন্তু এই সুখ বেশিদিন টিকল না। একদিন পরীক্ষার আগে প্রচণ্ড টেনশনে আবার একটা সিগারেট ধরাল। তারপর থেকে আবার চলল পুরনো চক্র।

বিয়ের পর জীবন

শিক্ষা শেষ করে চাকরি পেল সোহাগ। মিতাকেই বিয়ে করল। সংসার হলো, সন্তানও এলো। কিন্তু সিগারেট ছাড়তে পারল না।
প্রতিদিন অফিস শেষে বাড়ি ফিরে ধূমপান করতে যেত বারান্দায়। ছোট্ট ছেলে এসে বলত,
— "বাবা, তুমি আবার ধোঁয়া খাচ্ছো কেন?"

সোহাগ মুচকি হেসে বলত,
— "এটা তোমার বাবার ওষুধ।"
কিন্তু ভিতরে ভিতরে জানত, এটা ধীরে ধীরে তাকে মেরে ফেলছে।

শরীরের ভাঙন

৪০ বছর বয়সের কাছাকাছি এসে একদিন হঠাৎ প্রচণ্ড কাশি উঠল। গলা থেকে রক্ত বের হলো। হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার বললেন,
— "আপনার ফুসফুস খারাপ হয়ে গেছে। ধূমপানের জন্যই এ অবস্থা। এখনই না ছাড়লে খুব বিপদ হবে।"

সোহাগ প্রথমবার ভীষণ ভয় পেল। ছোট্ট ছেলেটির মুখ মনে পড়ল। স্ত্রীর চোখের জল দেখল।
চেষ্টা করল ছাড়তে। কিন্তু প্রতিদিন ভেতরে ভেতরে শরীর কাঁপত, মাথা ব্যথা করত, মেজাজ খারাপ হয়ে যেত। ধূমপান না করলে যেন পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসে।

শেষ লড়াই

একদিন রাতে ছেলে এসে আঁকড়ে ধরল বাবাকে। বলল,
— "বাবা, আমি চাই না তুমি মারা যাও। তুমি সিগারেট খেয়ো না।"

এই কথাটা সোহাগকে ভিতর থেকে নাড়া দিল। পরদিন থেকেই সে চিকিৎসকের কাছে গেল। নিকোটিন গাম, কাউন্সেলিং— সবকিছু শুরু করল।
প্রথম কয়েক মাস ছিল ভীষণ কঠিন। কিন্তু ধীরে ধীরে অভ্যাস কমতে লাগল।

নতুন ভোর

এক বছর পর সোহাগ নিজেকে ধূমপানমুক্ত দেখতে পেল। শরীরও আগের চেয়ে অনেক ভালো লাগতে শুরু করল। মিতা চোখ ভিজিয়ে বলল,
— "আমি জানতাম তুমি পারবে।"

এখন সে প্রতিদিন ছেলেকে নিয়ে হাঁটতে যায়। গ্রামের স্কুলে গিয়ে কিশোরদের বোঝায়—
"ধোঁয়ার ভেতরে সুখ নেই, আছে কেবল মৃত্যু। আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম জীবনের অনেক বছর, তোমরা যেন তা না করো।"

উপসংহার

সোহাগের গল্প আসলে হাজারো মানুষের গল্প। সিগারেট ও বিড়ির ধোঁয়া প্রথমে বন্ধুর মতো এসে কাছে টানে, কিন্তু শেষমেশ জীবনকে গ্রাস করে নেয়।
যদি ইচ্ছা থাকে, তবে যেকোনো মানুষই ধূমপান ছাড়তে পারে। কিন্তু যত তাড়াতাড়ি শুরু করা যায়, ততই ভালো।