হার না মানা ভালোবাসা


রাত গভীর। চারপাশ নিস্তব্ধ। রেহান ছাদের চেয়ারে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তার হাতে নীলার পুরোনো ডায়েরি। প্রতিটি শব্দ যেন বুকের ভেতরে হাহাকার তুলছে। প্রতিটি বাক্য যেন তাকে ফিরিয়ে নিচ্ছে সেই দিনগুলোতে— যেখানে ছিল ভালোবাসা, প্রতিশ্রুতি আর এক অদ্ভুত ব্যথা।


প্রথম দেখা


বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন। ক্লাসরুমে ঢুকতেই রেহানের চোখ আটকে গেল। প্রথম বেঞ্চে বসা এক মেয়ে, চুপচাপ, চোখে অদ্ভুত এক শান্তি। নীলা।


রেহান পরে বলেছিল—

— “নীলা, তোমার চোখ দুটোতে আমি প্রথম দিনেই ডুবে গিয়েছিলাম। যেন পুরো পৃথিবী সেখানে লুকিয়ে আছে।”


নীলা হেসেছিল লাজুক ভঙ্গিতে।

— “তুমি সবসময় অতিরঞ্জিত কথা বলো।”


কিন্তু সেই দিন থেকেই তারা একে অপরের কাছে টান অনুভব করেছিল। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব জমল, আর অজান্তেই ভালোবাসার রঙে রাঙা হয়ে উঠল তাদের দু’জনের পৃথিবী।


প্রতিশ্রুতির দিন


এক বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকের ধারে বসে নীলা বলল,

— “রেহান, জীবন খুব অনিশ্চিত। যদি কখনো আমাদের আলাদা হতে হয়?”


রেহান তার হাত শক্ত করে ধরল, চোখে দৃঢ়তা—

— “না নীলা। যা-ই হোক, আমি কখনো তোমার হাত ছাড়ব না। হার মানব না।”


নীলার চোখে অশ্রু টলমল করছিল।

— “তুমি জানো, এই কথাটাই আমার ভরসা হয়ে থাকবে।”


ঝড় নেমে এলো


শেষ বর্ষে হঠাৎ ঝড় নেমে এলো। নীলার বাবা ব্যবসার কারণে পুরো পরিবারকে কানাডায় নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। নীলা ভেঙে পড়ল।


— “রেহান, আমি চাই না দূরত্ব আমাদের শেষ করে দিক। আমি ভয় পাচ্ছি।”


রেহান তার চোখ মুছিয়ে দিল।

— “ভালোবাসা কখনো দূরত্ব মানে না। আমি অপেক্ষা করব, যতদিনই লাগুক।”


কিন্তু বিদেশে গিয়ে ধীরে ধীরে নীলার যোগাযোগ কমে গেল। সময়, ব্যস্ততা আর দূরত্ব সবকিছু গ্রাস করল। একসময় ফোন বন্ধ হয়ে গেল, মেসেজের উত্তর আসা বন্ধ হয়ে গেল।


তারপর একদিন ভোরে নীলা লিখল—

— “পরিবার আমাকে বিয়েতে চাপ দিচ্ছে। আমি খুব অসহায়।”


রেহানের মনে হলো পৃথিবী ভেঙে পড়েছে। কাঁপা হাতে উত্তর দিল—

— “যদি একটুও ভালোবাসা বেঁচে থাকে, আমার জন্য অপেক্ষা করো। আমি জানি, ভালোবাসা হার মানে না।”


এরপর নীরবতা। কোনো উত্তর নেই, কোনো খবর নেই।


হারিয়ে যাওয়া বছরগুলো


সাত বছর কেটে গেল। বন্ধুরা বলল, “ভুলো, নতুন করে জীবন শুরু করো।” কিন্তু রেহান পারেনি। প্রতিদিন রাতে আকাশের তারাদের দিকে তাকিয়ে শুধু একটা কথাই বলত—

— “নীলা, আমি এখনো আছি, তোমার জন্য।”


তার বুকের ভেতর প্রতিশ্রুতির আগুন নিভে গেল না।


হঠাৎ ফিরে আসা


এক সন্ধ্যায় ফেসবুক মেসেঞ্জারে নোটিফিকেশন। প্রেরক— নীলা।


— “রেহান, তুমি কি আমাকে এখনো মনে রেখেছ?”


রেহানের চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। কাঁপা আঙুলে লিখল—

— “আমি কখনো ভুলিনি।”


নীলা জানাল, সে বিয়ে করেনি। পরিবারের চাপ সামলাতে সে একা লড়েছে। রেহানের দেওয়া প্রতিশ্রুতিই তাকে শক্তি দিয়েছে। পড়াশোনা শেষ করে সে আবার ঢাকায় ফিরেছে।


পুনর্মিলন


পরদিন সন্ধ্যায়, সেই পুরোনো লেকের ধারে।


নীলা দাঁড়িয়ে আছে। আগের চেয়ে পরিণত, কিন্তু চোখে এখনো সেই আলো।


নীলা ধীরে বলল,

— “তুমি জানো, এই সাত বছর আমি প্রতিদিন ভেবেছি— তুমি হয়তো আমাকে ভুলে গেছ। কিন্তু তোমার প্রতিশ্রুতিই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল।”


রেহান ভিজে চোখে তার হাত ধরল—

— “ভালোবাসা সত্য হলে সেটা হারায় না, নীলা। আমি হার মানিনি।”


নীলা কেঁদে ফেলে মাথা রাখল রেহানের বুকে। দু’জনের বুকের ধ্বনি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।


নতুন ভোর


কয়েক মাস পর ছোট্ট এক অনুষ্ঠানে তারা বিয়ে করল। আজ রাতে, ছাদের চেয়ারে বসে রেহান যখন ডায়েরি বন্ধ করল, নীলা তার পাশে এসে বসল।


— “কী পড়ছো?”


— “তোমার লেখা। তোমাকে ছাড়া আমার গল্প কখনো পূর্ণ হতো না।”


নীলা মৃদু হাসল, মাথা রাখল তার কাঁধে। আকাশ ভরা তারারা যেন সাক্ষী হলো— হার না মানা ভালোবাসার জয়গান।